Saturday, August 29, 2020

কবি জীবনের সেই ট্রাজিক https://ift.tt/eA8V8J

 

ড. রঞ্জিত বিশ্বাস

‘প্রিয় হাইদর, তুমি এখনই চলে এস। অমলেন্দুকে আজ পুলিশ ধৎৎবংঃ করেছে। আমি কাল থেকে অসুস্থ। ইতি -নজরুল।’

লিখছেন নজরুল, ১০ই জুলাই ১৯৪১ সালে। বোঝা যাচ্ছে, ৯ই জুলাই ১৯৪১ থেকে উনি অসুস্থ, এবং লেখালিখি তাঁর পক্ষে আর করা হয়ে উঠবে না। কয়েকদিন পরেই, তখন তিনি শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রতিষ্ঠিত ‘নবযুগ’ পত্রিকার সম্পাদক, লিখছেন সহকারী সম্পাদক ব্রজেন রায়চৌধুরীকে, ‘প্রিয় ব্রজেন, কাল থেকে তুমি বফরঃড়ৎরধষ লিখবে। আমি অক্টোবরের মধ্যেই ভাল হয়ে যাব। ফাল্গুন থেকে নব বসন্তের মতো তেজ পাব। নৌজোয়ান হবো। তোমাদের বৌদি ভাল হয়ে যাবেন, বন্ধু বলেছেন’।

কবি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মাত্র বিয়াল্লি¬শ বছর বয়স তখন তাঁর।  তার আগেই ১৯৩৯ সালে স্ত্রী প্রমীলা দেবী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছেন। কোমরের নিচ থেকে অসাড়। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য লেখালিখি আর গানের চুক্তির জন্য প্রাপ্য সব রয়্যালটি বন্ধক রাখলেন কবি, পেলেন মাত্র চারশ’ টাকা! তখন তিনি আকাশবাণী কলকাতাতে কর্মরত। অসুস্থ স্ত্রীকে সুস্থ্য করবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলেন। ১৯৪০ এ ফিরলেন সাংবাদিকতায়,  নবযুগ পত্রিকার সম্পাদক হয়ে।

১৯৪১ এর ৭ই আগস্ট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু সংবাদে বিহ্বল নজরুল লিখলেন ওই দিনই একটি কবিতা ও একটি গান। উনার আবৃত্তিকরা সেই কবিতা, রবিহারা, অল ইন্ডিয়া রেডিও বাজাল। আর নজরুল, স্বরচিত গান, ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত কবিরে, স্বকণ্ঠে গেয়ে রাজপথে মিছিলের সঙ্গে হেঁটে চললেন। পরে সেই গান ইলা ঘোষের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে রেকর্ড করলেন। মাস খানেকের মধ্যেই নজরুল চরম অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কথা বলার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেললেন। কথাবার্তায় এবং ব্যবহারে হঠাৎ করে রুক্ষতা প্রকাশ পেতে লাগলো, খরচে অসংযম। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠছেন, অল্পেই ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটছে। শরীর ভেঙে পড়ছে, ক্রমশ ঘোর বিষাদ আর হতাশা গ্রাস করছে। কবির মানস জগৎ ধীরে ধীরে ঘন অন্ধকারে অপসৃয়মান। কবি নিজে খাওয়ার ও স্নান করার ক্ষমতা হারাচ্ছেন। অসুস্থ শরীরেও প্রমীলা দেবী যতœ করবার চেষ্টা করছেন, খাইয়ে দিচ্ছেন। মা গিরিবালা দেবী কে আনিয়েছেন, সংসারের হাল ধরেছেন। সঙ্গে শুরু হয়েছে অর্থকষ্ট, চেনা বন্ধুরা ধীরে ধীরে অচেনা হয়ে যাচ্ছে। চুক্তিমাফিক প্রাপ্য রয়্যালটির টাকাও দিচ্ছে না বিভিন্ন প্রকাশক এবং গানের কোম্পানি।

হোমিওপ্যাথি ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসাতে কোনো ফল মিলল না। এমনকি, বন্ধু হায়দর পীর সাহেবকেও ডেকে আনলেন যদি আধ্যাত্মিক পথে কোনো উপশম হয়। দুই সুফি সন্ত সুফি মোহাম্মদ আব্দুস শুকুর গাজীপুরী এবং আব্দুল খালেককে ডেকে আনলেন। এরা বললেন, মুসলমান কবির হিন্দু পরিবেশে চিকিৎসা করালে কোনো উপশম হবে না! অন্য একজন, পীর আকছারুদ্দিন মত প্রকাশ করলেন, কবির বুকের বামপার্শ্বটা অর্থাৎ হৃদপিন্ডটা একেবারেই বিকল হয়ে গেছে। বিরক্ত কবি বলে ফেললেন, হায়দর আমার শত্রু!

১৯৪২ সালের ২৫ মে সজনীকান্ত দাস এবং জুলফিকর হায়দরের উদ্যোগে নজরুল সাহায্য সমিতি গঠিত হলো, আবেদনে তেমন সাড়া মিলল না। এদিকে মানসিক বৈকল্য স্পষ্টতর হচ্ছে। পাগলা-গারদে চার মাস চিকিৎসা চললো। সময় বয়ে চলে, বেড়ে চলে নজরুলের অসুস্থতা, সেই সঙ্গে পাল¬া দিয়ে দারিদ্র্য।

১৯৪৪ সালে নজরুল সাহিত্যচক্রের উদ্যোগে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে সজনীকান্ত দাস ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে সভাপতির ভাষণের উপর খবর করে অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হলো, অভঃবৎ জধনরহফৎধহধঃয হড়নড়ফু যড়ষফ ঃযব সরহফং ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ইবহমধষ সড়ৎব ঃযধহ ছঁধুর ঘধলৎঁষ ওংষধস নু ৎিরঃরহম ংড়হমং. ঐব ধিং ধনড়াব পড়সসঁহধষরংস, ধহফ ধষধিুং ষড়ড়শবফ ঁঢ়ড়হ ইবহমধষ ধং ধ যিড়ষব. ১৯৪৫ সালে কবি নজরুলকে তাঁর সাহিত্য কীর্তির জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী পদকে সম্মানিত করা হলো। এর কিছুদিন পর, সংসারের অভিভাবক হয়ে যিনি হাল ধরেছিলেন, গিরিবালা দেবী, নিখোঁজ হয়ে গেলেন।

১৯৫২ তে কবি নজরুল কে নিয়ে যাওয়া হল রাঁচির মানসিক হাসপাতালে। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসা চললো, কিন্তু কোনো উপশম হলো না। শুভাধ্যায়ীরা ‘নজরুল চিকিৎসা তহবিল’ গড়ে অর্থ জোগাড় করে ১৯৫৩র মে মাসে নজরুল এবং প্রমীলা দেবীকে ইউরোপ  পাঠানোর বন্দোবস্ত হল। লন্ডনে চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে বললেন এতদিন সেরকম কোন চিকিৎসায় হয়নি কবির। এরপর, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে নিয়ে গিয়ে দেখানো হলো সেখানকার সেরা স্নায়ু-শল্যবিদ ড. হান্স হফকে। তিনি পরীক্ষা করে দেখে বললেন, কবি নজরুল ভুগছেন পিক’স ডিজিজে, যে রোগের কোনো চিকিৎসা নেই, এবং ইতিমধ্যেই অনেক দেরী হয়ে গেছে ও রোগ অনেক গভীরে পৌঁছেছে। ডাক্তারি পরিভাষায় যে রোগের নাম-ফ্রন্টও-টেম্পোরাল ডিমেনশিয়া। স্নায়ুতন্ত্র বিকলকারী রোগ, আলঝাইমারের মতো, কিন্তু আলঝাইমার নয়। আচার আচরণের অসংগতি আসে প্রথমে, কার্য-কারণ সম্পর্কে যুক্তিবোধ থাকে না, তারপর স্মৃতি লোপ পায়। আলঝাইমার রোগে আগে স্মৃতিশক্তি লোপ পায়, পরে আসে আচরণে অসংগতি। স্নায়ুকোষ জড়িয়ে দলা পাকিয়ে যায়, কখনো বা ফুলে ওঠে। ১৯৫৩র ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, সাত মাস ইউরোপে চিকিৎসার আশায় কাটিয়ে, আবার ফিরে এলেন কলকাতায়। ১৯৬০ সালে সম্মানিত হলেন পদ্মভূষণ পুরস্কারে।

কবির জীবনে ঘনঘটার শেষ নেই। ১৯৬২র ৩০ জুন প্রমীলা দেবী গত হলেন। কবির মা, জাহিদা খাতুন, অমৃতলোকে চলে গেছেন ১৯২৮ এ, আর ঠিক পরের বছর গুটিবসন্তে চলে গেল প্রাণাধিক প্রিয় বুলবুল। শোক তখন বড় বেজেছিল বুকে।

১৯৭২এ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার, ভারত সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় নজরুল কে নিয়ে গেলেন ঢাকায়। ২৪ মে।  বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা পেলেন। ১৯৭৪ এ অকাল মৃত্যু কেড়ে নিল কাজী অনিরুদ্ধ কে। এবার শোক কবিকে স্পর্শ করল কিনা কেউ বুঝলো না। ১৯৭৬ এ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব এবং একুশে পদকে সম্মানিত হলেন।

১৯৭৬ এর ২৯ আগস্ট কবি নজরুল চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। লক্ষ মানুষের ঢল নামল পথে কবিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই চিরশয়নে রইলেন বিদ্রোহী, যাঁর পাঁচ-পাঁচটা বই বাজেয়াপ্ত করেছিল বৃটিশ পুলিশ, যিনি জেলে যেতে ভয় পেতেন না, যাকে বন্দী করে অত্যাচার করে দুর্বল করা বৃটিশ বাহিনীর অসাধ্য ছিল।

‘সত্য স্বয়ং প্রকাশ। তাকে কোন রক্ত-আঁখি রাজদ- নিরোধ করতে পারে না। আমি সেই চিরন্তন স্বয়ম প্রকাশের বীণা, যে বীণায় চিরসত্যের বাণী ধ্বনিত হয়েছিল। আমি ভগবানের হাতের বীণা।’- আসুন, প্রতিজ্ঞা করি, কবি নজরুলের সাথে সমস্বরে বলি, চিরসত্যের সেই বাণী ধ্বনিত হোক আমাদের মর্মে, আমাদের কর্মে।

The post কবি জীবনের সেই ট্রাজিক appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/34Ilcn7

No comments:

Post a Comment