Friday, February 19, 2021

জীবনানন্দ দাশ : কবিতায় সমর্পিত মহৎকবি https://ift.tt/eA8V8J

ফারুক সুমন
‘আমার কবিতাকে বা এ-কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে; কেউ বলেছেন, এ-কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা প্রধানত ইতিহাস ও সমাজ -চেতনার, অন্য মতে নিশ্চেতনার; কারো মীমাংসায় এ-কাব্য একান্তই প্রতীকী; সম্পূর্ণ অবচেতনার; সুররিয়ালিস্ট। আরো নানারকম আখ্যা চোখে পড়েছে। প্রায় সবই আংশিকভাবে সত্য-কোনো-কোনো কবিতা বা কাব্যের কোনো-কোনো অধ্যায় সম্বন্ধে খাটে; সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়। কিন্তু কবিতাসৃষ্টি ও কাব্যপাঠ দুই-ই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি-মনের ব্যাপার; কাজেই পাঠক ও সমালোচকদের উপলব্ধি ও মীমাংসায় এত তারতম্য। একটা সীমারেখা আছে এ-তারতম্যের; সেটা ছাড়িয়ে গেলে বড়ো সমালোচককে অবহিত হ্থতে হয়।’ (জীবনানন্দ দাশ, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকা)

বাংলা কবিতার শৈল্পিক ভূমিতে জীবনানন্দ দাশ অবস্থান করছেন বিস্ময় চিহ্ন হয়ে। তিনি ‘ব্যক্তি ও কবি’ এই দুই সত্ত্বাকে সম্পূর্ণ সমর্পিত রেখে কাব্যচর্চায় নিবিষ্ট ছিলেন। তাঁর সমসময়ে কিংবা উত্তরকালে কাব্যদ্যুতির এমন স্ফুরণ অল্পই দেখা গেছে। বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের পরে সবচেয়ে বেশি প্রভাববিস্তারি কবি বোধকরি জীবনানন্দ দাশ। এযাবৎ তাঁকে নিয়ে, তাঁর কবিতার বিষয় ও আঙ্গিকের অভিনবত্ব নিয়ে কম লেখা হয়নি। তবুও তাঁর কবিতার ভাঁজ, বর্ণিল কারুকাজ নিয়ে লেখা ফুরোবে বলে মনে হয় না। মহৎ কবিতা বুঝি এমনই। ধ্রুপদী কবিতার সৌরভ যুগযুগ ধরে এভাবেই ছড়িয়ে পড়ে জনে জনে, মনে মনে।

‘নিখাদ কবিতার কবি’ হিসেবে বাংলা কবিতাঙ্গণে জীবনানন্দ দাশের অবস্থান এখন সুচিহ্নিত। তাঁর কবিতার বিষয় ও প্রকরণে উৎকীর্ণ আছে বর্ণিল কাব্যালঙ্কার। প্রথমে বাক্যেই উল্লেখ করেছি ‘বাংলা কবিতার শৈল্পিক ভূমিতে জীবনানন্দ দাশ অবস্থান করছেন বিস্ময়চিহ্ন হয়ে।’ ‘কবিতার শৈল্পিক ভূমি’ বলেছি একারণে যে, কবিতা অনেক রকম। কোনো কোনো কবিতা বক্তব্য নির্ভর। যেখানে শিল্পের দায়বদ্ধতা থাকে কম। সময়, সমাজ কিংবা ব্যক্তি-জীবনের উন্মোচনে কবি সদা উন্মুখ থাকেন। এই প্রকাশ সব কবি সমান ভাবে করতে পারেন না। শিল্পানন্দের চেয়ে কবি মনোযোগী হয়ে ওঠেন জীবনের গল্প বয়ানে। কিন্তু জীবনানন্দ কবি হিসেবে এখানেই সফল এবং স্বতন্ত্র। তাঁর কবিতায় সময়, সমাজ কিংবা দেশ কিছুই বাদ যায়নি। এতদসত্ত্বেও শিল্পসফল কবিতা সৃষ্টিতে তিনি সফল হয়েছেন। কবিতায় উপমা, চিত্রকল্প, রূপক, প্রতীক এবং মিথের ব্যবহার ঘটিয়ে বাংলা কবিতার ধারায় স্বতন্ত্র সরণি তৈরি করেছেন। সমকালীন ইংরেজি কিংবা ফরাসি কবিতার আধুনিক ঔজ্জ্বল্য জীবনানন্দের কবিতার হাত ধরে বাংলা কবিতার জমিনকে উর্বর করে। একারণে দিন যত গত হয় ততই তাঁর কবিতা পাঠকের অনুভবে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে ধরা দেয়। জ্যাক দেরিদা বোধকরি এটাকেই ‘ভাঁজকরা কার্পেটে’র সাথে তুলনা করেছেন। মহৎ শিল্পের ভাঁজ যতই উন্মোচিত হবে ততই শিল্পরসে সিক্ত হবে পাঠকের মন।
জীবনানন্দের কবিতা পাঠক নন্দিত কেন? তাঁর কবিতা কেনই-বা উত্তরকালের কবিকূলের কাছে এতো আদরনীয়? এমন জিজ্ঞাসার জবাব যুগযুগ ধরে খোঁজার প্রয়াস ছিলো, আছে, থাকবে। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিসত্ত্বার উন্মোচন করেন আত্মবিশ্বাসের শিরদাঁড়া উঁচু করে। ‘ঝরা পালক’ কাব্যগ্রন্থের ‘আমি কবি-সেই কবি’ কবিতায় তাঁর উচ্চারণ-

‘আমি কবি-সেই কবি-
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
আনমনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল-মেঘের পানে!
মৌন নীলের ইশারায় কোন কামনা জাগিছে প্রাণে!
বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন কাজরীর গানে!
দাদুরী-কাঁদানো শাঙন-দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি!’

এখানেই জীবনানন্দের শক্তিমান কবিসত্ত্বার আগাম ইঙ্গিত লক্ষণীয়। অসীম আকাশে দৃষ্টি স্থির করে তিনি ঝরে পড়া পালকের দৃশ্যকে কল্পনায় এঁকে ফেলেন। এই দৃশ্য তাঁর কবিমানসে মৌন বারতা দেয়। দৃষ্টির সীমানায় ভেসে বেড়ায় ‘হিঙুল-মেঘ’। মনের অন্দরে কাজরীর গান বাজে। সেই গানের মূর্ছনায় বুকের বাদল উথলি ওঠে। এভাবেই কবিহৃদয় দ্রবীভূত হয় কবিতার জন্যে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাংলা কবিতায় আধুনিকতার যে বুনন আমরা প্রত্যক্ষ করি। জীবনানন্দ দাশ তাঁর সৃজনপ্রতিভার গুণে সেই বলয় থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। এটা সম্ভব হয়েছে তাঁর কাব্যভাষার ওজস্বিতা এবং বিষয়ের ব্যঞ্জনাবহ উপস্থাপনের গুণে। তিরিশের দশকে উল্লেখযোগ্য কিছু পত্রিকা বাংলা সাহিত্যের নতুন গতিপথ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। সেগুলো হলো ‘প্রগতি’, ‘কালিকলম,’ ‘কল্লোল,’পরিচয়’, ইত্যাদি। প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী-সহ প্রমুখ কবি এই পত্রিকাগুলোকে কেন্দ্র করে লেখায় উচ্চকিত ছিলেন। বাংলা কবিতায় রোমান্টিক ভাবালুতার যে ধারা এতোদিন প্রবহমান ছিলো। জীবনানন্দ-যুগে এসে কবিতায় যুক্ত হলো জীবনঘনিষ্ঠ অনুভূতিজাত নানা উপাখ্যান। বাংলা কবিতা হয়ে উঠলো বহুবিধ ভাবনার আধার।
এটা ঠিক, সমকালে জীবনানন্দের কবিতা উপেক্ষিত ছিলো। কবি হিসেবেও তিনি পাঠকের নিকটবর্তী ছিলেন না। দুর্বোধ্য কিংবা দুরূহ কাব্যভাষার অভিযোগে তাঁর কবিতা সমালোচকের কলমে বেশ কাটাছেঁড়া হয়েছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতার ভাষা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। ‘তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহসিত করে।’
জীবনানন্দের কাব্যভাষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নেতিবাচক মন্তব্য করলেও উত্তরকালে জীবনানন্দের কাব্যভাষাই তাঁর কবিতাকে প্রাতিস্বিক মর্যাদা দিয়েছে। কাব্যভাষার কারুকাজ দেখিয়ে জীবনানন্দ দাশ কবিতায় স্বতন্ত্র স্বর সৃষ্টি করেছেন। জীবনানন্দ-পরবর্তীকালের বাংলা কবিতা সেই ভাষাকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আধুনিক কিংবা উত্তরাধুনিক বাংলা কবিতার উঠোনে যতই তত্ত্বকথার উন্মেষ ঘটুক, এর পশ্চাৎপটে জীবনানন্দের কবিতা এবং কাব্যবোধের দাপট কতটা গভীরে প্রোথিত তা সহজেই অনুমেয়। অনুসন্ধিৎসু পাঠক কিংবা কবিতানুরাগী চাইলে জীবনানন্দের কবিতা এবং তাঁর উত্তরপ্রজন্মের কবিতা পাশাপাশি রেখে নিবিড় পর্যবেক্ষণে অবতীর্ণ হতে পারেন।
জীবনানন্দের কবিতা পাঠককে ঘোরগ্রস্ত করে রাখে। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি মানুষ বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জীবনচক্রকে পরিভ্রমণ করে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আবিষ্কার করে রহস্যে ঘেরা এক মনোজগৎ। জীবনানন্দের পঙতিগুলো পাঠকের রহস্যে ঘেরা মনোজগতের অনুভবে নাড়া দেয়। বিমূর্ত বিশ্বে অবগাহন শেষে পাঠক যখন তীরে এসে ভিড়ায় ভাবনার ভেলা। তখন অতৃপ্ত মন আবার ফিরে যেতে চায় কবিতার মায়ালোকে।
শিল্পের এই অতৃপ্তি পাঠকের মনে রুয়ে দিয়েই কবি জীবনানন্দ স্মরণীয় বরণীয় হয়ে চলেছেন যুগযুগ ধরে। তেমন কিছু কবিতার চরণ আমরা পড়তে পারি-
ক.
‘একদিন মনে হ’তো জলের মতন তুমি।
সকালবেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা-
অথবা দুপুরবেলা-বিকেলের আসন্ন আলোয়-
চেয়ে আছে-চ’লে যায়-জলের প্রতিভা।’
(তোমাকে / শ্রেষ্ঠ কবিতা)
খ.
‘মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালো।
এইখানে পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে
এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে।
তাদের স¤্রাট নেই, সেনাপতি নেই;
তাদের হৃদয়ে কোনো সভাপতি নেই;
… ….. ….. ….. ….. …. ….. …. …..
কেমন আশ্চর্য গান গায়;
বোবা কালা পাগল মিনসে এক অপরূপ বেহালা বাজায়;
গানের ঝংকারে যেন সে এক একান্ত শ্যাম দেবদারু গাছে
রাত্রির বর্ণের মতো কালো কালো শিকারী বেড়াল
প্রেম নিবেদন করে আলোর রঙের মতো অগণন পাখিদের কাছে;
ঝর ঝর ঝর
সারারাত শ্রাবণের নির্গলিত ক্লেদরক্ত বৃষ্টির ভিতর।’ (এইসব দিনরাত্রি / শ্রেষ্ঠ কবিতা)
তবে রবীন্দ্রনাথ এবং কাজী নজরুল ইসলাম কবিতার ভাষা ও বিষয়ে যে স্বতন্ত্র মনোভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। জীবনানন্দ সে পথে হাঁটেননি। এমনকি কাব্যচর্চার শুরুতে ‘ঝরা পালক’ (১৯২৭) কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের কবিতার ছায়া থাকলেও পরবর্তী সময়ে তাঁর কবিতা নিজস্ব পথরেখা খুঁজে নেয়। রাজনীতি কিংবা মানুষের কথা সরাসরি উচ্চকিত হয় নজরুলের কবিতায়। রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের কবিতার অনুগামী না হয়ে জীবনানন্দ দাশ অভিনব উপমা, চিত্রকল্প এবং প্রতীকের আশ্রয় নিয়েছেন। প্রয়োগকৃত কাব্যালংকার এবং কাব্যোপকরণ আবহমান গ্রামবাংলার গাঘেঁষা। বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির বাতাবরণে কবিতার বিষয় ও শৈলী নির্মিতির ফলে তাঁর কবিতা দুর্বোধ্যতার ব্যূহ ভেদ করে ছুঁয়েছে পাঠকের মন।
যেমন-

‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে-সব চেয়ে সুন্দর করুণ:
সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপি ঘাসে অবিরল;
….. ….. ….. ….. ….. …. ….. …. …..
সেখানে লেবুর শাখা নুয়ে থাকে অন্ধকারে ঘাসের উপর;
সুদর্শন উড়ে যায় ঘরে তার অন্ধকার সন্ধ্যার বাতাসে;
সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের ‘পর-
শঙখমালা নাম তার: এ বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে
তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো- বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর,
তাই সে জন্মেছে বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।’ (এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে/রূপসী বাংলা)

কবি হিসেবে জীবনানন্দ দাশ ছিলেন প্রচন্ডরকম আত্মমগ্ন। সমকালে পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের ব্যাপারে তাঁর ভাবনা ছিলো কবিতার মগ্ন সামিয়ানার নিচে। একারণে ব্যক্তি হিসেবেও তিনি খুব একটা মনোযোগের কেন্দ্রে ছিলেন না। ফলে সৃষ্টি হয়েছে দূরত্ব। পরিবার এবং প্রতিবেশী তাঁকে ভুল বোঝার অবকাশ পেলো। কবিও ক্রমাগত একলা হয়ে গেলেন। একারণে জীবনানন্দের কবিতার একটা বিশেষ সুর দুঃখবোধ ও নিঃসঙ্গতা। কখনো নেতিবাচক অভিব্যক্তিও আভাসিত হতে দেখা যায়। কবি যেন নৈরাশ্যবাদীদের একজন হয়ে ওঠেন। ‘অন্ধকার’-এর প্রতীকে ঘুরেফিরে তিনি আছড়ে পড়েন বেদনার বালুচরে। তিনি একা যেমন-
ক.
সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?
(বোধ/ধূসর পান্ডুলিপি)
খ.
আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত- রাত্রিটিরে ভালো ,
খড়ের চালের্থপরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার ;
পুরানো পেঁচার ঘ্রাণ ;- অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো !
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ ,- মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশত্থের ডালে ডালে ডাকিয়াছে বক ;
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এইসব নিভৃত কুহক;
(মৃত্যুর আগে/ ধূসর পান্ডুলিপি লিপি)
জীবনানন্দের কাব্য-অনুভব নিসর্গময়। বাংলা কবিতায় নিসর্গের নিবিড় চলন এবং ব্যক্তিগত অনুভূতির আধারে নিসর্গ-কে রূপায়নের ক্ষেত্রে তিনি অদ্বিতীয়। লোকজ শব্দের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপমা ও চিত্রকল্পের বিন্যাস তাঁর কবিতাকে আবহমান বাংলা কাব্যধারায় স্বতন্ত্র অভিধা দিয়েছে। শব্দের অর্থগত শক্তি ও সম্ভাবনার উজ্জ্বল উদাহরণ তাঁর কবিতার শব্দশৈলী। পূর্বসূরি শক্তিমান কবিদের সৃষ্ট কবিতার পাটাতনে দাঁড়িয়ে তিনি খুঁজে নিলেন নিজস্ব কাব্যস্বর। বাংলার প্রকৃতি ঋতুবৈচিতের্যর গুণে বহুবর্ণী রূপ ও রঙে আভাসিত হয়। জীবনানন্দের কবিতায় তার চিত্রময় প্রকাশ লক্ষণীয়। প্রকৃতির পরতে পরতে ছিলো নিঃসঙ্গ জীবনানন্দের অন্বেষণ এবং মানসভ্রমণ।

ক.
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়-
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক
জোনাকির দেহ হতে- খুঁজেছি তোমারে সেইখানে-
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রানের অন্ধকারে ধানসিড়ি বেয়ে বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।
(শঙ্খমালা / বনলতা সেন)
খ.
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হ্থয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হবো-কিশোরীর-ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে-ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলায় নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে।
(আবার আসিব ফিরে / বনলতা সেন)
জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতার প্রাতিস্বিক স্বরের গুণে বাংলা কবিতার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। দৃশ্য-কে দৃশ্যাতীত অর্থবহতায় ব্যঞ্জনা দিতে চিত্রকর যেমন হাতে তুলে নেন রংতুলি। কবিও সেই দৃশ্যের আরাধনায় হাতড়ে ফেরেন যথাবিহিত শব্দসম্ভার। জীবনানন্দ তাঁর কাব্যভাষায় ভাব ও বিষয়ের দৃশ্যাতীত চিত্র আঁকতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি কেবল শব্দের মালা গেঁথেই ক্ষান্ত হননি, কবিতার পঙক্তিকে হৃদয়গ্রাহী করেছেন আবেগ, কল্পনা, অভিজ্ঞতা এবং বোধের গভীর প্রকাশ ঘটিয়ে।

The post জীবনানন্দ দাশ : কবিতায় সমর্পিত মহৎকবি appeared first on Daily Patradoot Satkhira.



from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/3k2ASaF

No comments:

Post a Comment