রিয়াদ হোসেন
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল উপকূলীয় বাঁধ ভেঙে আবারও লক্ষ লক্ষ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট জেলাসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে নদীর প্রবল জোয়ারের চাপ এবং বিরামহীন ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বেড়িবাঁধ ভেঙে এ প্ল¬াবন সৃষ্টি হয়েছে।
সাগর, নদী এবং সুন্দরবন দ্বারা পরিবেষ্টিত ও বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষদের ঝড়, প্লাবন, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে বারবার পতিত হতে হয়। এরমধ্যে ঝড় ও সামদ্রিক প্ল¬াবনের কবলে পড়ে বারবার সর্বশান্ত হয় মানুষ। এ সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে অপরিসীম ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষের। বহু মানুষের প্রাণহানীসহ বন্য ও গৃহপালিত পশু-পক্ষী, ঘর-বাড়ি গাছ-পালা ও ফসলের ক্ষতি সাধন হয়েছে সীমাহীন।
এ বছর আগস্টের মাঝামাঝি সময় হতে ভারী বৃষ্টিপাত এবং জোয়ারে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে খুলনার কয়রা, পাইকগাছা উপজেলা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগর উপজেলায় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তাদের বসতবাড়ি, জমি-জমা, গৃহপালিত পশু-প্রাণির এক মুমূর্ষু অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এসব মানুষরা সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে পরিবারের ছোট শিশু এবং বয়স্কদের নিয়ে। চারিদকে পানি আর পানি। ছোট শিশুকে সবসময় কাছে রাখা ছাড়া নেই কোন উপায়। পাশাপাশি বয়স্ক মানুষগুলোকে খাওয়ানো, গোসল করানোসহ দৈনন্দিন কাজ কর্মে বিরাট এক বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন এসব জনপদের মানুষ। কোন উপায় নেই নিত্যদিনের চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া বা অনন্য কাজ কর্ম করার। পত্র-পত্রিকা খুললে এসব মানুষের অসহায়েত্বের চিত্র স্পষ্টভাবে দেখা যায়। কীভাবে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে সেটা ব্যাখ্যা করা খুবই কষ্টকর। এছাড়াও এসব অঞ্চলে নলকূপ ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। যার ফলে লোকজন আমাশয়, ডায়রিয়া, টাইফয়েড, দেখা দিচ্ছে। কিছু মশাবাহিত রোগ ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু সৃষ্টি হচ্ছে। সর্বোপরি দেখা গেছে, আবহাওয়া ও তাপমাত্রার তারতম্যজনিত কারণে এসব মানুষ নানা রকম ভাইরাসজনিত অসুখ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দি-কাশি, গলাব্যথা, সাইনোসাইটিস ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
পার্বত্য ঢলের বন্যা খুলনা, সাতক্ষীরা কিংবা বাগেরহাট জেলায় তেমন ব্যাপক আকারে কখনও দেখা যায়নি। গঙ্গা, পদ্মায় যখন পানি বৃদ্ধি পায় তখন স্বভাবতই এসব জেলার নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি পায়। কূল ছাপিয়ে বন্যা সৃষ্টির আগেই পানি সমুদ্রে গমনের সহজ পথ খুঁজে পায়। ফলে ব্যাপক আকারে বন্যার সৃষ্টি করতে পারে না। তবে এ ধরনের পানি স্ফীতির ফলে উত্তরাঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়। এবছরের মাঝামাঝি সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক আকারে বন্যা দেখা দিয়েছে। উত্তরাঞ্চলীয় কুড়িগ্রাম, জামালপুরসহ আরও কয়েকটি জেলার লক্ষ লক্ষ মানুষ পানিবন্দি হয়ে বেশ কিছু দিন ধরে জীবন যাপন করছে। তবে বেশ কিছুদিন ধরে পানি দিনের পরিক্রমায় কমতে শুরু করেছে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে সুন্দরবন ব্যতীত জেলার বেশিরভাগ অঞ্চল এখন উপকূলীয় বাঁধ পরিবেষ্ঠিত। বেশিরভাগ বাঁধগুলো পরিমিত উঁচু এবং মজবুত না হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এ ধরনের প্লাবন দেখা দিচ্ছে। স্লুইস গেট সমূহের বাইরে ও নদীতে পলি জমেছে। কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন কারণে স্লুইস গেটগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারায় একটানা বেশিদিন বৃষ্টিপাত হলে অভ্যন্তরের নদী, খাল অতিরিক্ত পানির স্থান সংকুলান করতে পারে না। আর যেখানে স্লুইস গেট অকেজো সেখানে সহজেই অবস্থা ভয়াবহ রুপ ধারন করছে।
ভূগোল ও পরিবেশের শিক্ষক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলছেন, ‘এবারের মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি, হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। আর সাম্প্রতিককালে নদীগুলোতে তলানি জমছে বেশি। নদীর প্রবাহ ক্ষমতা কমে গেছে। তাই বৃষ্টি বেশি হলেই প্ল¬াবন হচ্ছে, সময়মত পানিটা নেমে যেতে পারছে না।’
তবে এর ভিতরেও একটি স্বস্তির খবর হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের এই বিপদে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে তিনি সাতক্ষীরায় যেসব গ্রামগুলো প্ল¬াবিত হয়েছে সেসব গ্রামকে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ২০০ মেট্রিকটন চাল এবং ২ লক্ষ টাকা দিয়েছেন। এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি জেলায় এমনিভাবে তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এছাড়াও তিনি সকল বিত্তবান, প্রভাবশালীদের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন-এসব অসহায়, দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।
সুতরাং আমাদের সকলের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে একতা, বন্ধুত্ব এবং সম্প্রীতি। আসুন, পর্যাপ্ত ত্রাণ নিয়ে বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়াই, বিপদগ্রস্ত মানুষদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই। এমন একটি সমাজ গড়ে তুলি যেই সমাজে থাকবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সহমর্মিতা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মানবতার কল্যাণে কাজ করি। আর একটি কথা, সেটা হচ্ছে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই কোন না কোন ধর্মে বিশ্বাসী। আর প্রত্যেক ধর্মই মানব কল্যাণকে ধর্মীয় কাজের অংশ করেছে। সুতরাং মানবতার পাশে দাঁড়ানো, বন্যায় বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদেরকে আর্থিকভাবে সাহায্য করাটা ধর্মীয় কাজেরই অংশ। তাই আজ আর কোন ধরনের অজুহাত নয়, কোন ধরনের পিছুটান নয়। সকল ভেদাভেদ ভুলে আসুন সবাই মিলে দুর্গত এসব মানুষদের পাশে দাঁড়াই। আপনার আমার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সর্বহারা এসব মানুষেরা আবারো তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক-এটাই হোক আমাদের সকলের চাওয়া।
The post প্লাবিত উপকূল: মানবেতর জীবন appeared first on Daily Patradoot Satkhira.
from Daily Patradoot Satkhira https://ift.tt/2CTZuRE
No comments:
Post a Comment